দুর্গাপূজার মুখরোচক খাবার: মেঘালয় থেকে মিষ্টান্ন — এক স্বাদপর

উৎসব আসে, আর উৎসব মানেই তো মন ভরে খাওয়া-দাওয়া! বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা শুধু আধ্যাত্মিকতার নয়, এটি আসলে এক বিশাল ভোজন উৎসব। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত, প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি প্যান্ডেলে যেন খাবারের এক অবিরাম মেলা বসে। প্যান্ডেল হপিংয়ের মাঝে, প্রতিমা দর্শনের ফাঁকে, অথবা বন্ধুদের আড্ডায়—খাবারই যেন প্রতিটি মুহূর্তকে আরও রঙিন করে তোলে। এবারের পুজোয় আমরা শুধু বাংলার চেনা স্বাদে আটকে থাকব না, বরং এক নতুন স্বাদপর্বে পাড়ি দেব। এই যাত্রা শুরু হবে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে, আর শেষ হবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির থালায়। চলুন, এই স্বাদ-সফরে ডুব দিই!


দুর্গাপূজার মুখরোচক খাবার

পর্ব ১: মেঘালয়ের পাহাড়ি রান্নাঘরের স্বাদ-অভিযান

দুর্গাপূজার এই সময়ে অনেকেই উত্তর-পূর্ব ভারতে বেড়াতে যান। আর মেঘালয়ের রন্ধনশৈলী তার নিজস্বতা ও বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। বাঙালি খাবারের মতো মসলার আধিক্য এখানে কম, বরং উপকরণগুলির নিজস্ব স্বাদকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বিশেষত, চাল এবং শুয়োরের মাংস (Pork) এখানকার প্রধান উপাদান। মেঘালয়ের প্রধান তিনটি উপজাতি, খাসি, গারো এবং জয়ন্তিয়া, তাদের নিজস্ব রান্নার স্টাইল এবং খাবার ঐতিহ্য বহন করে।

ক. খাসি উপজাতির মুখরোচক পদ

খাসি খাবারের স্বাদ প্রধানত টাটকা উপকরণ এবং হালকা মশলার উপর নির্ভর করে।

  • জাদোহ (Jadoh): এটি একটি সুস্বাদু এবং সুগন্ধি চালের পদ। এটি এক ধরনের বিরিয়ানির মতো, তবে এর স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুয়োরের মাংস, চাল এবং স্থানীয় মশলা দিয়ে এটি রান্না করা হয়। অনেক সময় এতে কাঁচা বাঁশের কোড়ল (Bamboo Shoot) ব্যবহার করা হয়, যা একটি অনন্য স্বাদ যোগ করে। জাদোহের সঙ্গে প্রায়শই ডোহ-নেইওং (Doh-neiong) পরিবেশন করা হয়, যা একটি কালো তিলের সস দিয়ে তৈরি শুয়োরের মাংসের পদ। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার ক্লান্তি দূর করতে এটি সত্যিই এক দুর্দান্ত খাবার।

  • ডোহ খলিয়েহ (Doh Khlieh): এটি সেদ্ধ করা শুয়োরের মাংস, পেঁয়াজ, আদা, লেবুর রস এবং নানা ধরনের মশলা দিয়ে বানানো একটি স্যালাড। এর স্বাদ টক এবং মশলাদার হয়। দুর্গাপূজার সকালের দিকে এটি একটি হালকা এবং মুখরোচক জলখাবার হিসেবে খাওয়া যেতে পারে।

  • পুথারো (Putharo): চাল থেকে তৈরি এক ধরনের পিঠে বা রুটি হলো পুথারো। এটি স্টিম করে বানানো হয় এবং নরম তুলতুলে হয়। সাধারণত এটি ডোহ-নেইওং বা অন্য যেকোনো মাংসের তরকারির সঙ্গে খাওয়া হয়।

  • বমপ্লা (Bompla): এটি শুয়োরের মাংস এবং আদা দিয়ে তৈরি এক ধরনের আচার, যা স্বাদে খুব মশলাদার হয় এবং প্রধান খাবারের সঙ্গে খাওয়া হয়।

খ. গারো উপজাতির ঐতিহ্যবাহী খাবার

গারো রান্নায় ঝাল এবং মশলার ব্যবহার কিছুটা বেশি। তাদের রান্নায় প্রধানত চালের গুঁড়ো এবং বাঁশের কোড়লের ব্যবহার দেখা যায়।

  • না'কাম বিচি (Na'kam Bitchi): এটি এক ধরনের শুঁটকি মাছের ঝোল।

  • মি'আম (Mi'am): এটি একটি বিশেষ ধরনের শুয়োরের মাংসের তরকারি, যা সাধারণত বাঁশের কোড়ল দিয়ে রান্না করা হয়।

গ. জয়ন্তিয়া উপজাতির বিশেষ রান্না

জয়ন্তিয়া অঞ্চলের খাবার খাসি খাবারের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ, তবে তাদের নিজস্ব কিছু বিশেষ পদও আছে।

  • পুখলাইন (Pukhlein): এটি চালের গুঁড়ো এবং গুড় দিয়ে তৈরি একটি মিষ্টি পিঠে।

এই খাবারগুলো শুধু মেঘালয়ের মানুষেরাই পছন্দ করেন না, বরং ভিন্ন স্বাদের সন্ধানে থাকা খাদ্যপ্রেমীদের জন্যও দারুণ আকর্ষণীয়। দুর্গাপূজার এই সময়ে ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভিন্ন স্বাদের এই খাবারগুলি আপনার উৎসবকে আরও স্মরণীয় করে তুলবে।

পর্ব ২: চিরায়ত বাংলার ভোজ: দুর্গাপূজার ঐতিহ্যবাহী রান্না

মেঘালয়ের স্বাদ গ্রহণ শেষে আমরা ফিরে আসি নিজেদের চেনা বাংলায়। এখানে দুর্গাপূজার প্রতিটি দিনের নিজস্ব কিছু রান্নার চল আছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।

ক. ষষ্ঠী: উৎসবের সূচনালগ্ন

ষষ্ঠীর দিন সাধারণত বাড়িতে হালকা রান্না হয়। এই দিনের প্রধান আকর্ষণই থাকে নতুন পোলাও-মাংসের সুগন্ধ।

  • ডাল-রুটি: ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় গরম গরম মুগ ডালের খিচুড়ি বা সবজি দিয়ে পাতলা রুটি খাওয়া যেতে পারে।

  • ইলিশের পাতুরি: ষষ্ঠী থেকে বিজয়া, যেকোনো দিনই গরম ভাতের সঙ্গে সরষে ইলিশের পাতুরি এক অনবদ্য পদ।

  • পাঁঠার মাংসের ঝোল: অনেকে ষষ্ঠীর দিন থেকেই মাংস রান্না শুরু করেন।

খ. সপ্তমী: ভোজের শুরু

সপ্তমীর দিনে ভোজের আসল আনন্দ শুরু হয়। এদিন সাধারণত বাড়িতে নানা ধরনের পদ রান্না করা হয়।

  • শুঁকতো: সপ্তমী সাধারণত নিরামিষাশীদের জন্য। তাই শুঁকতো একটি অন্যতম প্রধান পদ।

  • লুচি ও আলুর দম: এটি এক এমন জুটি যা দুর্গাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সকালে গরম গরম লুচি আর আলুর দম ছাড়া বাঙালির উৎসব অসম্পূর্ণ।

  • চিরাচরিত মাছের পদ: দুপুরে ভাতের সঙ্গে কাতলা মাছের কালিয়া বা রুই মাছের কোফতা একটি দুর্দান্ত পদ।

গ. মহা-অষ্টমী: ভোগের স্বাদ

অষ্টমীর দিনে অঞ্জলি দেওয়ার পর প্রসাদ হিসেবে ভোগ গ্রহণ করা বাঙালির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ভোগের প্রধান পদ হলো খিচুড়ি, যা গোবিন্দভোগ চাল এবং মুগ ডাল দিয়ে তৈরি হয়। এর সঙ্গে থাকে লাবড়া, যা বিভিন্ন ধরনের সবজি দিয়ে বানানো একটি পদ। লাবড়ার সঙ্গে থাকে বেগুনি, ফুলুরি বা আলুর চপ। এছাড়াও অনেক জায়গায় ছানার ডালনা বা আলুর দম পরিবেশন করা হয়। ভোগের এই স্বাদ দুর্গাপূজার সঙ্গে যেন এক হয়ে মিশে আছে।

ঘ. মহা-নবমী: ভূরিভোজের রাত

নবমীর রাত মানেই জমকালো খাওয়া-দাওয়া। এই রাতে সাধারণত আমিষ পদ প্রাধান্য পায়।

  • কষা মাংস: দুর্গাপূজার দিনে সাধারণত বাঙালি বাড়িতে পাঁঠার মাংসের কষা রান্না করা হয়। মশলাদার এই পদ লুচি, পরোটা বা সাদা ভাতের সঙ্গে দারুণ লাগে।

  • পোলাও ও চিকেন রোস্ট: পোলাও এবং রোস্ট চিকেন নবমীর রাতের জন্য একটি দারুণ বিকল্প।

  • চিংড়ি মালাইকারি: নারিকেলের দুধ দিয়ে তৈরি চিংড়ি মালাইকারি যেকোনো উৎসবে এক অন্য মাত্রা যোগ করে।

  • বিরিয়ানি: আজকাল অনেক পরিবারে নবমীর রাতে কলকাতা বিরিয়ানি বা হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি রান্না করা হয়।

ঙ. বিজয়া দশমী: বিদায়ের মিষ্টি স্বাদ

দশমীর দিনে মিষ্টিমুখ ছাড়া সব কিছু অসম্পূর্ণ। বিজয়া দশমীর দিনে বাড়ির অতিথিদের মিষ্টি পরিবেশন করা হয়।

পর্ব ৩: মিষ্টিমুখের মহিমা: মিষ্টান্নের স্বর্গে বিচরণ

পূজার খাবারের শেষ পর্বটি হলো মিষ্টিমুখ। মিষ্টি ছাড়া বাঙালির কোনো উৎসবই সম্পূর্ণ হয় না।

ক. মিষ্টান্নের রাজা-রানি: রসগোল্লা ও সন্দেশ

রসগোল্লা এবং সন্দেশ ছাড়া মিষ্টির পর্ব অসম্পূর্ণ। পূজার সময় এই দুটি মিষ্টির চাহিদা থাকে তুঙ্গে। নলেন গুড়ের সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা এবং জলভরা সন্দেশ - প্রতিটি মিষ্টিই স্বাদে ও গন্ধে একে অপরের থেকে আলাদা।

খ. চিরায়ত মিষ্টি: নারু ও মালপোয়া

পূজার সময় বাড়িতে তৈরি মিষ্টির মধ্যে নারকেলের নারু এবং তিলের নারু অন্যতম। এই নারুগুলো পূজার সময় বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়দের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এছাড়াও মালপোয়া একটি খুব জনপ্রিয় মিষ্টি। ক্ষীর বা রাবড়ি দিয়ে তৈরি মালপোয়া গরম গরম খেতে অসাধারণ লাগে।

গ. আধুনিক মিষ্টান্ন: ফিউশনের চমক

ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পাশাপাশি আজকাল নানা ধরনের ফিউশন মিষ্টিও বাজারে পাওয়া যায়। মিষ্টি দই চিজকেক, নলেন গুড়ের আইসক্রিম বা রসগোল্লার পুডিং - এই ধরনের মিষ্টিগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে খুব জনপ্রিয়।

পর্ব ৪: পাণ্ডাল হপিংয়ের স্ট্রিট ফুড গাইড

পূজার সময় প্যান্ডেল হপিংয়ের মাঝে বিরতি নিতে রাস্তার পাশের খাবার স্টলগুলো যেন এক স্বর্গের সন্ধান দেয়। এখানেও রয়েছে নানা ধরনের মুখরোচক খাবার।

  • ফুচকা: দুর্গাপূজার ফুড গাইড ফুচকা ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। টক জল ও তেঁতুলের মিষ্টির মিশেলে আলুভরা ফুচকা এক স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয়।

  • ঘুঘনি: ঘুগনি হলো মটর ডাল দিয়ে তৈরি একটি পদ। এটি সাধারণত লেবুর রস, পেঁয়াজ কুচি এবং কিছু মশলা দিয়ে খাওয়া হয়।

  • কাঠি রোল: ডিম, চিকেন বা মাটন দিয়ে তৈরি কাঠি রোল খুব সহজে এবং দ্রুত পেটের ক্ষুধা মেটাতে সাহায্য করে।

  • অন্যান্য: এছাড়াও সিঙ্গারা, চপ, মোমো, ইত্যাদি রাস্তার খাবারের মধ্যে অন্যতম।

দুর্গাপূজা আসলে শুধু একটি উৎসব নয়, এটি একটি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিতে খাবারের স্থান অনস্বীকার্য। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে বাংলার মাঠ, প্রতিটি প্রান্তের খাবারই যেন পূজার আমেজে নতুন স্বাদ এনে দেয়। তাই এবারের পুজোয় শুধু পোশাক আর আড্ডায় নয়, বরং খাবারের স্বাদেও মেতে উঠুন।

শুভ শারদীয়া!

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url